পশুর খামার ব্যবসায়, শুরুটা করবেন যেভাবে, সভ্যতার শুরু থেকে পশু পালন ছিল মানুষের প্রধান পেশা। যুগে যুগে এই পেশার ধরণ বদলেছে। সারা পৃথিবীতে পশুর খামার ব্যবসা একটি অন্যতম উৎপাদনশীল এবং লাভজনক ব্যবসা। নিউজিল্যান্ড, হল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বৃহৎ আকারে শতভাগ বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনায় পশুর খামার পরিচালিত হয়। এসব খামারের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা, উৎপাদন তাক লাগিয়ে দেবার মত। বর্তমানে ভারতে বাণিজ্যিক আকারে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে খামার ব্যবসা শুরু হয়েছে এবং ভারতীয় উদ্যোক্তা মোটা অংকের মুনাফা দেখতে শুরু করেছে।
ভৌগলিক অবস্থানের কারণে প্রাণিসম্পদ ব্যবসায় বাংলাদেশ উন্নত দেশগুলির চেয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তবে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ সম্ভব হলে আমাদের দেশেও প্রাণিসম্পদ খামারকে লাভজনক করা সম্ভব। সত্যি বলছি, আমাদের দেশে শিক্ষিত কোন কৃষি উদ্যোক্তা নেই। আমি মনে করি না এই পেশাকে আধুনিকীকরণের জন্য সরকার, সমাজ ও পরিবার থেকে কোনও উত্সাহ রয়েছে। বিষয়টি আইনটির একটি অনুপযুক্ত বিধান বলে মনে হয়, পেশাটি কেবল পাতলা, দরিদ্র বা আধা শিক্ষিত বেকার যুবকদের জন্য এই ধারণাটি তাত্ক্ষণিকভাবে পরিবর্তন করা দরকার। বলা বাহুল্য, কৃষি-উদ্যোক্তারা ভবিষ্যতের বিশ্ব অর্থনীতির শীর্ষে থাকবে। বাংলাদেশ কৃষিক্ষেত্রের অনেক সম্ভাবনা সম্পন্ন একটি দেশ।
প্রথমেই মাথায় রাখতে হবে পশুর খামার ব্যবসায় একটি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। প্রথমে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত প্রাণীসম্পদ তৈরি করতে হবে তারপর সেই সম্পদ থেকে প্রকৃত উৎপাদন শুরু করতে হবে। সাধারণত ২-৩ বছর একাগ্রতার সাথে ধৈর্য নিয়ে পরিশ্রম করলে ভাল স্টার্ট-আপ করা যায়। জমি চাষ করা থেকে শুরু করে সোনালী ধান ঘরে তোলা পর্যন্ত যে পরিচর্যা ও সময় প্রয়োজন কৃষিক্ষেত্রে কাজের ধরন অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় এবং শ্রম দিতেই হবে। সুতরাং অসীম ধৈর্য ও সাহস নিয়ে খামার ব্যবসা শুরু করতে হবে। শুরু করার আগে যে বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে তা নিচে পর্যায়ক্রমে বর্ণনা করা হল।
১। পণ্য নির্বাচন:
আপনার খামার থেকে কি ধরণের পণ্য উৎপাদন করবেন তা নির্ধারণ করতে হবে। অর্থাৎ আপনি ব্রীড, দুধ, মাংস, পশম উৎপাদন করতে পারেন। তাছাড়া বাই প্রোডাক্ট হিসাবে দুগ্ধজাত পণ্য বা মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ করতে পারেন। যেটাই করুণ আপনাকে একটি নির্দিষ্ট উৎপাদন যোগ্য পণ্য নির্ধারণ করতে হবে এবং সে অনুসারে আপনার খামারের পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, দুধ উৎপাদন করলে ফ্রিজিয়ান বা সংকর জাতের গাভীর খামার, মাংস উৎপাদন করতে চাইলে বিফ ফ্যাটেনিং বা উন্নত জাতের ছাগল-ভেড়ার খামার, পশম করতে চাইলে উন্নত জাতের ভেড়া (মাটন মেরিনো জাতটি এখন বাংলাদেশের আবহাওয়ায় পালন উপযোগী বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন) এবং দুগ্ধজাত পণ্য পনির, মাখন করতে চাইলে মিল্ক গোট খামার করা যেতে পারে।
২। বাজার নির্বাচন:
আপনার উত্পাদনের ধরণ অনুসারে আপনি কোন স্তরের বাজারে বাজার জাত করবেন তা আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দেশের সামগ্রিক বাজারে প্রচুর চাহিদা রয়েছে তবে আমরা যদি সেই অনুপাতে উত্পাদন ও সরবরাহ করতে চাই তবে আমাদের প্রচুর বিনিয়োগ করতে হবে। আমি এখানে মোটামুটি ছোট বিনিয়োগ দিয়ে শুরুটা কিভাবে করা যায় সে বিষয়ে বলতে চাই। নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য লোকাল মার্কেট নির্বাচন করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। ব্যবসায় বড় হবার সাথে সাথে আপনার টার্গেট বাজার বড় হতে থাকবে।
৩। পশুর জাত নির্বাচন:
খামার শুরু করার জন্য সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল পশুর জাত নির্বাচন। মাথায় রাখতে হবে ভাল জাতের পশুর উপর আপনার খামারে উন্নতি নির্ভর করবে। সেক্ষেত্রে শতভাগ ব্লাড-লাইন সম্পন্ন পশু সংগ্রহ করা সব থেকে উত্তম। তবে এক্ষেত্রে বিনিয়োগ লাগবে অনেক। খামার করার জন্য ভাল জাতের ৭০-৮০ শতাংশ ব্লাড-লাইন সম্পন্ন পশু সংগ্রহ করলেই চলবে। খামারের অন্যান্য ব্যবস্থাপনা ঠিক থাকলে খামার মুনাফা দেখবে আশা করা যায়।
৪। জমি নির্বাচন ও অবকাঠামো পরিকল্পনা:
খামারের জন্য নিজস্ব জমি হলে সবথেকে উত্তম। তাছাড়া আপনি জমি লিজ বা কট (যে এলাকায় যে চুক্তিতে জমি ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে) নিয়ে খামার শুরু করতে পারেন। খামারের অবকাঠামো এবং ঘাসের জমির জন্য খামারের ধরণ অনুযায়ী নুন্যতম ৫ বিঘা জমি প্রয়োজন। যদিও ঘাসের বিকল্প খাদ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে পারলে ঘাসের জমির প্রয়োজনীয়তা থাকবেনা। ঘাসের বিকল্প খাদ্য নিয়ে পরবর্তী লেখায় পাওয়া যাবে। খামারের জন্য নির্বাচিত জমি অবশ্যই লোকালয় থেকে দূরে হতে হবে এবং অবশ্যই সংযোগ সড়ক, পানি, বিদ্যুতের সুব্যবস্থা থাকতে হবে। নিরাপত্তার বিষয়টি খুব গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে।
জমি নির্বাচনের পর খামারের অবকাঠামোর একটা খসড়া পরিকল্পনা করতে হবে। কোন ধরনের উপকরণ দিয়ে কম খরচে আধুনিক অবকাঠামো তৈরি সম্ভব সে বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। দেশীয় উপকরণ ব্যবহার একটি উত্তম পন্থা হতে পারে। মনে রাখবেন আপনার বিনিয়োগের সব থেকে বড় অংশ ব্যয় হবে পশুর শেডে। পরবর্তী লেখায় কম খরচে আধুনিক খামার আবকাঠামো নিয়ে লিখবো। খামারের জন্য নির্বাচিত জমি অবশ্যই লোকালয় থেকে দূরে হতে হবে এবং অবশ্যই সংযোগ সড়ক, পানি, বিদ্যুতের সুব্যবস্থা থাকতে হবে। নিরাপত্তার বিষয়টি খুব গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে।
৫। পরিকল্পনা প্রণয়ন:
এই পর্যায়ে, আমাদের পরিকল্পনা শুরু করতে হবে। তার আগে আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন প্রাণীটি (গরু, ছাগল, ভেড়া বা মহিষ) দিয়ে খামার শুরু করবে এবং সেই প্রাণী সম্পর্কে অধ্যয়ন শুরু করবে। সেই পশুর সাধারণ বৈশিষ্ট্য, প্রজনন কাল, উৎপাদন ক্ষমতা, স্বাস্থ্য, খাদ্য গ্রহণ, আচার-আচরণ সম্পর্কে বিস্তর ধারনা নিতে হবে। সে কারণে নিজে নিজের প্রশিক্ষক হওয়া যথেষ্ট। কোন ট্রেনিং করার দরকার নেই। ইন্টারনেটের সুবাদে এই সমস্ত তথ্য এখন হাতের নাগালে। সময় নিয়ে মনোযোগের সাথে পড়াশোনা করে এবং খামার ব্যবসা সংক্রান্ত অন্যান্য তথ্যাদি সংগ্রহ করে দুই বছরের একটি রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। পরবর্তীতে সেই রোডম্যাপ ধরে এগোতে হবে।